হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন,আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রাঃ) একদিন ভাষণ দিলেন। তাতে তিনি বললেন,“অদূর ভবিষ্যতে এই উম্মতের মধ্যে এমন এক জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটবে,যারা রজমকে (ব্যভিচারের দায়ে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করার দণ্ডবিধি) অস্বীকার করবে,দাজ্জালের আগমনকে অস্বীকার করবে,কবর আজাবকে অস্বীকার করবে,সুপারিশ অস্বীকার করবে এবং একদল গুনাহগার মুসলমান জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি লাভ করার আকীদাকে অস্বীকার করবে।” (ফাতহুল বারী খণ্ড ১১,পৃষ্ঠা ৪২৬)
বিভিন্ন ভূখণ্ডে ইহুদী খ্রিষ্টানদের অর্থে প্রতিপালিত বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও বেসরকারি সংস্থাগুলো তাদের প্রভুদের পরিকল্পনায় নিত্যদিন ইসলামী বিধিবিধান নিয়ে ঠাট্টা মশকরা ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে চলছে এবং ইসলামী চিন্তা চেতনা ও বোধ-বিশ্বাসকে মানুষের জীবন থেকে চিরতরে মুছে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছে। ইসলাম,ইসলামী আইন ও ফতোয়া ইত্যাদি নিয়ে এমনভাবে আলোচনা চলছে,যেন এসব কোন মানুষের তৈরি আইন। হাল আমলে বিভিন্ন দেশের এমন কিছু বুদ্ধিজীবি-চিন্তাবিদের আবির্ভাব ঘটেছে,যারা বিভিন্ন ব্লগ ও টক শোতে রজম ও অন্যান্য ইসলামী দণ্ডবিধিকে এযুগে অচল সাব্যস্ত করছে। তাছাড়া দাজ্জালের আগমনকে অস্বীকার করার মতো লোকও বর্তমান যুগে বিদ্যমান রয়েছে। ভবিষ্যতে বিষয়টিকে ‘বিতর্কিত’বানিয়ে ফেলা হবে,তাতে কোনই সন্দেহ নেই।
মানুষ যখন সৃষ্টিকর্তা থেকে দূরে সরে যায় এবং অদৃশ্যের মহাজ্ঞানী প্রভুর সাথে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যায়, তখন তার কাছে আর প্রকৃত বাস্তবতা ধরা দেয় না। যার কারণে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার জাদুতে বস হওয়া চোখসমূহ, প্রিন্ট মিডিয়ার বন্যায় ভেসে যাওয়া বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিবর্গদের কাছে নিয়মিত শয়তান উদয় হয়ে অন্তরে কুমন্ত্রণা সরবরাহ করতে থাকে। ফলে তাদের তাদের চিন্তা চেতনা আর দৃষ্টিভঙ্গিগুলো শয়তানের আয়ত্তাধীন হয়ে যায়। পক্ষান্তরে যাদের চিন্তা-চেতনা অদৃশ্যের মহাজ্ঞানী সত্তার রঙে রাঙায়িত থাকে, আল্লাহ তা’আলা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিসমূহকে সরল ও সঠিক পথে পরিচালিত করে দেন, চাই তাদের পথগুলো যতই না অন্ধকার, কণ্টকাকীর্ণ ও সংকটাপন্ন করে দেওয়া হোক না কেন।
এটা আজকালের কোন নতুন কথা নয়, বরং মানব ইতিহাস হক্ক ও বাতিলের যুদ্ধসমূহের তাজা সাক্ষী হয়ে আছে। এ যুদ্ধে বাতিলের পাল্লায় ব্যর্থতা এবং পরাজয় ছাড়া আর কিছুই অর্জিত হয়নি, তেমনি বাহ্যিক পরিস্থিতি আর আসবাবপত্রের উপর বিশ্বাসীরা সর্বদায় ধোঁকায় পড়ে আছে।
প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে আল্লাহপাক প্রকাশ্য দুটি চক্ষু প্রদানের পাশাপাশি অন্তরের ভিতরেও দুটি চক্ষু প্রদান করেছেন। প্রকাশ্য চোখদ্বয়ের মাধ্যমে সে বাহ্যিক পরিস্থিতি দেখতে পায়, পক্ষান্তরে অন্তর্চক্ষু ঐ সকল বস্তুর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তার প্রকৃত বাস্তবতাকে পরখ করে ফেলে। এ কারনেই নবী করীম সাল্লাহু আলাইহি ওয়া আল্লাম আল্লাহর কাছে সবসময় দোয়া করতেন, “হে আল্লাহ, আমার চোখে প্রতিটি বস্তুকে তার প্রকৃত চেহারায় দেখার তৌফিক দাও!!!”
প্রকাশ্য চোখদ্বয়ের অন্ধ ব্যক্তি এতটা দয়ার পাত্র নয়; যতটা অন্তরচক্ষু অন্ধ ব্যক্তি। কেননা, আপনি অসংখ্য প্রকাশ্য চোখের অন্ধ ব্যক্তিকে দেখতে পাবেন যে, সে তার অন্তর চক্ষুর মাধ্যমে স্বীয় সৃষ্টিকর্তা পর্যন্ত সফলভাবে পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়েছে এবং বাহ্যিক চক্ষুদ্বয় দ্বারা কোন কিছু দৃশ্যমান না হওয়া সত্তেও সে যাবতীয় পাপ কাজ থেকে শুধুমাত্র এ উদ্দেশ্য বেঁচে রয়েছে যে, তার মহান প্রভু তো তার যাবতীয় কাজ প্রত্যক্ষ করছেন। পক্ষান্তরে আপনি অসংখ্য প্রকাশ্য চক্ষুস্মান ব্যক্তিদেরকে দেখতে পাবেন যে, সবকিছু দেখা সত্ত্বেও তারা নিজেদের স্রস্টাকে চিনতে সক্ষম হয়নি, মানবতা এবং শয়তানীর মধ্যকার পার্থক্য বুঝতে পারেনি, মূর্খতা এবং জ্ঞানের মধ্যে তফাত সৃষ্টি করতে পারেনি, কোনটা অন্ধকার কোনটা আলো তারতম্য করতে পারেনি। প্রকাশ্য উজ্জ্বল আলোকিত পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে শয়তানের পেছনে পেছনে অন্ধকার পথের দিকে যাত্রা করেছে। তাদের মধ্যে আবার অনেক চিন্তাবিদ, প্রশিক্ষক, বিশেষজ্ঞ, ভাষণদাতা ও উপদেশদাতাকে আপনি দেখতে পাবেন। এদের মধ্যে আবার ভালো-মন্দ যাচাইয়ে অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীদেরকেও আপনার চোখে পড়বে। এটা শুধুমাত্র এ কারণেই যে, তাদের বাহ্যিক চক্ষুগুলো অক্ষত থাকা সত্ত্বেও অন্তর চক্ষুগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। প্রতিটি বস্তুকে তারা বাহ্যিক রূপ দেখেই বিচার করে ফেলে।
মরুপ্রান্তরে বসবাসকারী এক সস্প্রদায়, আশেপাশে কোন সমুদ্র নেই, যেখানে বন্যা আসারও কোন সম্ভাবনা নেই। এমতাবস্থায় তাদের কোন বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী ব্যক্তি যদি বিশালাকারের নৌকা বানানো শুরু করে দেয় আর সর্বসাধারণকে অপেক্ষামান মহাপ্লাবন থেকে সতর্ক করতে থাকে, এহেন পরিস্থিতিতে আপনি আন্দাজ করতে পারেন – অন্তর চক্ষুতে অন্ধ ব্যক্তিবর্গ ঐ ব্যক্তির সাথে কিরূপ আচরণ করবে!! এটাই যে, সবাই তাকে ঠাট্টা বিদ্রুপ করবে, পাগল বলে তাকে আখ্যায়িত করবে। এটা কেন? শুধুমাত্র এ কারণেই যে, তাদের মাথায় স্থাপিত দুটি চোখ চারিদিকে শুধু মরুভূমি প্রত্যক্ষ করছে, অদুরে কোন সমুদ্র বা আশেপাশে বড় কোন নদীরও অস্তিত্ব নেই, কখনও কোন প্লাবনের আভাসও সেখানে পাওয়া যায়নি। সমাজের গণ্যমান্য (Elite) ব্যক্তিবর্গও ঐ ব্যক্তির কথাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছে। সুতরাং অন্তর চক্ষুতে অন্ধ ব্যক্তি এই নৌকার বাস্তবতা পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হয়নি। বিপরীতে ঐ সকল লোক যাদের মন মস্তিস্ক উজ্জ্বল, প্রকাশ্য চোখদ্বয়ের সাথে সাথে অন্তর চক্ষুও সঠিকভাবে পরিচালিত, পাশাপাশি সতর্ককারী ঐ ব্যক্তিটিকেও ভালোভাবে চেনে যে, এক হাজার বছরের জিন্দেগিতে সে কখনও কারও সাথে মিথ্যা বলেনি, কখনও কারও সাথে বেঈমানি করেনি, প্রত্যেকের মঙ্গল কামনাই তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। এ সকল ব্যক্তিবর্গ তার কথাকে অবশ্যই সত্য বলে বিশ্বাস করবে – যদিও বাহ্যিক নিদর্শনসমূহ তার বিপরীতেই থাকুক না কেন!!
সুতরাং পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষী যে, অন্তর চক্ষুতে অন্ধ ব্যক্তিবর্গ ঐ মহাপ্লাবনে ভেসে গেছে, এমনকি তাদের নাম-নিশানা পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকেনি। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় স্তরের ব্যক্তিবর্গ মহাপ্লাবন থেকে রেহাই পেয়ে তারাই পরবর্তীতে বিশ্বময় মানব বংশ বিস্তারের মাধ্যম হয়েছে। তারা হচ্ছে ঐ স্তরের লোক, যারা আল্লাহর নবী হযরত নূহ (আঃ) এর উপর ঈমান এনে নৌকায় আরোহণ করে ধন্য হয়েছিল। বিপরীতে নিজেদেরকে বড় ভাবা সমাজের গণ্যমান্য চিন্তাবিদ, অধিপতি এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ আমূলে ধ্বংস হয়ে গেছে। তাদের জ্ঞান তাদেরকে রক্ষা করতে পারে নাই। তাদের গবেষণা আর অভিজ্ঞতাগুলো নির্ধারিত প্রতিশ্রুতিকে বিন্দুমাত্র সরাতে পারেনি।
আদ জাতির ইতিহাস লক্ষ্য করুন। এমন এক জাতি, যারা বিল্ডিং নির্মাণ (Architecture & Construction) জ্ঞানে উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিল, তারা পাহাড়ের ভিতরে পাহাড় কেটে কেটে বাড়ি নির্মাণ করত। নিরাপত্তা বিষয়ে তারা এমন ব্যবস্থাপনা তৈরি করেছিল যে, না আভ্যন্তরীণ কোন শত্রু তাদের উপর ধাওয়া করার শঙ্কা ছিল, না বাইরে থেকে কেউ এসে তাদের উপর চড়াও হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। মোটকথা নিজেদের বাসস্থান ও এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা তৈরি করে নিশ্চিন্তে তারা তাদের ঘরবাড়িগুলোতে জীবনযাপন করছিল। এমন সময় যদি তাদেরকে বলা হয় যে, তোমাদের এই সুউচ্চ ও পাহাড়সম ঘরবাড়িগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে। তবে বাহ্যিক পরিস্থিতির উপর ভরসাকারী, আকাশসম এ বিশাল অট্টালিকাগুলোর উপর গবেষণাকারী, নিরাপত্তার জন্য ব্যবহৃত ম্যাটেরিয়ালের সাইন্স নিয়ে গবেষণাকারীগণ কথাটিকে কিভাবে বিশ্বাস করে নিবে!!
কিন্তু ইতিহাস এখনও তাদের অন্ধ সাব্যস্ত করেছে। আদ জাতির সার্বিক উন্নয়নশীল, অত্যাধুনিক শক্তি, ভূমিকম্পরোধক এবং সর্বপ্রকার আশংকা থেকে মুক্ত এ সুউচ্চ বিল্ডিংগুলো থাকা সত্ত্বেও তাদের গর্বের অট্টালিকাসমূহকে নিমিষে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে পরবর্তী লোকদের জন্য এক মহাদৃষ্টান্ত দাঁড় করানো হয়েছে। অথচ আল্লাহ পাক তাদেরকে নিরাপত্তামূলক ঘরবাড়ীগুলোর বাইরে এনেও ধ্বংস করতে পারতেন। কিন্তু এর মাধ্যমে কেয়ামত পর্যন্ত আগত সকল গবেষক আর বিশেষজ্ঞদেরকে এটাই শিক্ষা দিয়েছেন যে, তোমাদের গবেষণা আর উন্নতি আল্লাহর থেকে পাঠানো বাস্তবতাকে কোন সময় প্রতিহত করতে পারবে না।
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে নমরুদ চল্লিশ দিন পর্যন্ত প্রজ্জলিত আগুনের বিশাল কুণ্ডে নিক্ষেপ করেছিল। বাহ্যিক চক্ষুস্মান ব্যক্তিবর্গ মনে করেছিল যে, আমরা আমাদের প্রভু বিদ্রোহকারী, মূর্তি চূর্ণকারী ইব্রাহীমকে আগুনে নিক্ষেপ করে তার হাড্ডিগুলো পর্যন্ত ছাই বানিয়ে দিয়েছি!!! কিন্তু বাস্তবতা ছিল তাদের ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত।
আল্লাহ তা’আলার দুশমন এবং আল্লাহর প্রিয় নবী হযরত ঈসা (আঃ) কে হত্যাকারী ইহুদীরা যখন ঈসা (আঃ) কে কাষ্ঠে চড়িয়ে মনে করেছিল যে, আমরা ইসাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়েছি। কিন্তু বাহ্যিক চক্ষুস্মানগণ এখানেও ধোঁকায় পড়েছিল। এখন পর্যন্ত তারা এই ধোঁকার মাঝেই নিমজ্জিত। কিন্তু আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন অন্তরচক্ষুর অধিকারীদেরকে ছয়শত বছর পর ঠিকই জানিয়ে দিয়েছেন যে, ঈসাকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়নি; বরং তাকে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। সুতরাং অন্তরচক্ষুর অধিকারীরা একথায় বিশ্বাস করে নিয়েছে। যদিও পরিস্থিতি তারা সচক্ষে দেখেনি।
সুতরাং আমরা যেন বিশ্বাসী পুরুষ ও মহিলা হিসাবে, আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বুঝতে গিয়ে শুধু পশ্চিমা মিডিয়া ও তাদের দালাল মিডিয়ার তথ্য ও ব্যাখ্যা উপর নির্ভরশীল না হই, আমরা যেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসের উপর নির্ভর করি যা আমাদের অন্তর চক্ষুকে খুলে
No comments:
Post a Comment